শেকলে বাঁধা শতাব্দী : মহসিনা সরকার
বই- শেকলে বাঁধা শতাব্দী,
লেখিকা- মহসিনা সরকার
প্রচ্ছদ- আহমাদুল্লাহ ইকরাম,
পাণ্ডুলিপি প্রকাশন,
কবিতা সংখ্যা- ৪৬ টি, সাথে অনেকগুলো আবেগগুচ্ছ
পৃষ্ঠা- ৬৩ টি
শতাব্দীকে শব্দের শেকলে বেঁধে রাখার যে প্রয়াস তাই 'শেকলে বাঁধা শতাব্দী' । যে শেকলে বন্দি থাকে খোঁপায় বেলিফুলের মালা গেঁথে রাখা প্রেমিকার উচ্ছাসভরা হাসিমুখ । লেখা থাকে উপার্জনহীন প্রেমিকের বুক পকেটে থাকা দুই পয়সার গোলাপ ফুলটার কথা । যেখানে লেখা থাকে মানবজীবনের সকল সুখ-দুঃখ, ভালবাসা, অভিমান আর অনুযোগের কথা । মূলত, এই জগত সংসারে মানব হৃদয়ের আটপৌড়ে যত ইচ্ছে আর ভরা জীবনের সুখগাঁথা নিয়েই রচিত হয়েছে 'শেকলে বাঁধা শতাব্দী' নামক উপাখ্যানটি ।
"শেকলে বাঁধা শতাব্দী"র কবিতাগুলোর অন্তরস্পর্শী সুর নাগরিক জীবনের সকল টানাপোড়েনের কথা বলে দেয় । বলে যায় সুখ-দুঃখের সকল ভাবাবেগে যাপিত জীবনের সকল সীমাবদ্ধতার কথা । এক জীবনের যত সুখ-দুঃখ, প্রেম, বিরহ-অভিমান ,ক্ষোভ, স্বপ্ন সবকিছু সরল অনুভবে কবিতা হয়ে ফুটে উঠেছে এই বইটিতে ! এই বইটিতে লিখেছেন প্রিয় মানুষদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠতে না পারার সীমাহীন আক্ষেপের কথা ।
বইটি পড়ে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই । এক কথায় অসাধারণ একটা বই । শব্দের নিটোল বুননে অনুভূতির সম্পূর্ণ বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এই বইটিতে ।
এর প্রতিটি কবিতাই উপমা অনুপ্রাসের অনন্য শৈলীতে ভরপুর ! এই বইটিতে আপু মূলত মানবিক জীবনের সহজাত ছন্দই অতি যত্ন সহকারে ফুটিয়ে তুলেছেন কবিতার ভাঁজে ভাঁজে । অবলীলায় লিখে গেছেন জগতের রূঢ়
বাস্তবতার কথা—
যে তোমারে নতুন করে বাঁচতে শেখায় রোজ,
সময় নিয়ে দেখো,
আঁধার হলেই কেউ রাখে না তার মৃত্যুর খোঁজ।"
বইটিতে আপু কয়েকটি অমীমাংসিত প্রশ্ন রেখে গেছেন, যেগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে শতাব্দীর পর শতাব্দী পার হয়ে যাবে । যেমন-
"কবি মরে গেলে সভ্যতা কাঁদে না কেন ?"
কবি মরে গেলে সভ্যতা কি সত্যিই কাঁদে না? কবিরাই তো হাসতে এবং কাঁদতে শেখান । তবে কি সভ্যতা স্বার্থপর? তারচেয়ে বড় প্রশ্ন, কবিরা কি আদৌ মারা যান?
মানবের সুখ-দুঃখ, আনন্দ আর সুখী মুহূর্তগুলো নিয়ে উপাখ্যান রচনা করে কবিরা কি মারা যেতে পারেন ?
এ রকম আরো কিছু প্রশ্ন রেখে গেছেন , যেগুলো পাঠককে বিরম্বিত করবে...
"ফিরে এলো পুরাতন প্রেম
অভিমানী কোনো সুরে,
তারে ডেকে ডেকে
কাছে টেনে নেবে কি ভেঙেচুরে?"
এই হিসেব কষতে বসেই লিখে ফেলেন,
"পালকের মতো খসে যাচ্ছে সময়
আমি ভর করে আছি শূন্যতায়
আড়ষ্টতায় ছিঁড়ে যাচ্ছে ব্যবধানবোধ"
তারপর যখন সন্ধ্যা নেমে আসে, মোহময়ী সূর্যাস্তের অন্তিম আলোয় শর্তহীন অনুযোগে আপন মনে গেয়ে উঠেন-
"আমার একজোড়া শান্ত চোখের নদ আছে
যেখানে অনুযোগের আহ্লাদে আমি
ইচ্ছে মতো মরে গিয়ে বেঁচে উঠি প্রতিবার"
বইটি শেষ করেছেন অনেকগুলো আবেগগুচ্ছ দিয়ে,
"আবেগ লুকিয়ে ভাবের বহর
কেটে যাক কিছু অচেনা প্রহর
যে সময় বেড়াজালে সবাই হারায়
শুধু জমে থাকে কিছু শূন্যতা।"
"তার হাসির বুমেরাং কিশতি-তে
আমার পৃথিবী মাতাল"
এই লাইনগুলো আমাকে আবেগে আপ্লুত করে, অনুভূতির দোলাচলে ভাসিয়ে নিয়ে যায় অনেক দূরে । যেখান থেকে পরিপূর্ণ তৃপ্তি নিয়ে আহরণ করি এক জীবনের অনন্ত তৃষ্ণার অমিয় জলের স্বাদ ।
আমি বলি, এই অক্ষরগুলো কখনো পুরনো না হোক । পায়রার পালকে শিশিরের শুভ্র ঘ্রাণ হয়ে লেগে থাক । পাঠকের হৃদয় জয় করে নক্ষত্রকাল অবধি ভালবাসা পাক......