সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব ও দার্শনিক ব্যাখ্যা: যুক্তি, দর্শন ও ইসলামের মিলনবিন্দু
ভূমিকা: সৌন্দর্যের আড়ালে লুকানো সত্তা
প্রতিদিন আমরা দেখি—সূর্য নিখুঁত নিয়মে উদিত হয়, সন্ধ্যায় নীরবে অস্ত যায়।
শীতের কুয়াশা শেষে আসে বসন্তের ফুলেল সৌরভ, তারপর বৃষ্টি ছুঁয়ে যায় পল্লীপ্রকৃতিকে।
নদী তার নিজস্ব গতিপথ ধরে ছুটে চলে, চাঁদ নির্দিষ্ট নিয়মে রূপ বদলায়,
নক্ষত্ররা রাতের আকাশে শোভা বাড়ায়—
এ এক অপার সৌন্দর্যের, এক অসাধারণ শৃঙ্খলার জগৎ!
কিন্তু এই সৌন্দর্য আর শৃঙ্খলা কি কেবল কাকতালীয়?
এত নিখুঁত হিসাব, এত ছন্দময় নিয়ম—এসবের পেছনে কি কেউ নেই?
কারো পরিকল্পনা নেই?
প্রকৃতির প্রতি যতই গভীর দৃষ্টি দিই, ততই যেন মনে প্রশ্ন জাগে—
কে এই অসীম কুশলী কারিগর?
তাঁকে তো আমরা চোখে দেখি না,
তাঁর কোনো গড়ন নেই, রঙ নেই, আকার নেই।
তবে কি এই দেখার অক্ষমতাই আমাদের মনে সন্দেহ জাগায়?
তাঁর অস্তিত্ব কি কেবল বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে, নাকি যুক্তির পথেও আমরা তাঁকে অনুভব করতে পারি?
এই প্রশ্নগুলোই আজ আমাদের এই চিন্তার যাত্রার সূচনা করে।
যেখানে আমরা সন্ধান করব সেই যুক্তির,
যা কেবল বিশ্বাসে নয়, যুক্তিবাদী মনেও সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব ও দার্শনিক ব্যাখ্যা: যুক্তি, দর্শন ও ইসলামের মিলনবিন্দু
এই বিশ্বজগৎ—এর সীমানা কোথায়, তা আমরা জানি না। প্রতিনিয়ত কোটি কোটি নক্ষত্র, গ্যালাক্সি, জীবজগৎ, নিয়ম ও জটিলতা আমাদের ভাবিয়ে তোলে—এই অসীম সৃষ্টির পেছনে কি আদৌ কোনো স্রষ্টা আছেন? যদি থাকেন, তবে তার অস্তিত্ব কি কেবল বিশ্বাসের ব্যাপার, নাকি যুক্তি ও দর্শনের আলোতেও আমরা তাঁর অস্তিত্ব অনুধাবন করতে পারি?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হয় ইতিহাসের বিখ্যাত দার্শনিকদের চিন্তার কাছে। আজ আমরা আলোচনা করব গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের একটি বিখ্যাত যুক্তি এবং দেখব সেটি কিভাবে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের সঙ্গে মিলে যায়।
কারণের শৃঙ্খল ও অ্যারিস্টটলের “Unmoved Mover” ধারণা
অ্যারিস্টটল ছিলেন যুক্তিবাদী। তিনি বাস্তব জগতে যা দেখতেন, তার জন্য কারণ খুঁজতেন। তিনি বলেন, “যে কোনো কিছুর অস্তিত্বের জন্য একটি কারণ থাকে।” কিন্তু এই কারণে কারণ খুঁজতে গেলে, আমরা অনন্ত এক শৃঙ্খলে ঢুকে যাই।
চিন্তা করুন—
ধরুন, A নামের একজন একটিঞ কলম তৈরি করতে চায়। কিন্তু তার জন্য অনুমতি নিতে হয় B-এর কাছ থেকে।
B আবার অনুমতি নেয় C-এর কাছ থেকে।
C কে নিতে হয় D-এর কাছ থেকে… এভাবে যদি অনুমতির এই ধারা অনন্তকাল চলতে থাকে, তাহলে কি A কোনো দিন কলম তৈরি করতে পারবে?
না, পারবে না। কারণ সে কখনোই চূড়ান্ত অনুমতির উৎসে পৌঁছাতে পারবে না। সুতরাং, যদি কিছু ঘটতে হয়, তবে এই অনুমতির শৃঙ্খল থামাতে হবে কোনো এক জায়গায়। এই থামার স্থানই হচ্ছে সেই "Unmoved Mover" — যে নিজে অকারণ, কিন্তু তিনিই সকল কিছুর চূড়ান্ত কারণ।
অ্যারিস্টটলের মতে, এই “Unmoved Mover” এর অস্তিত্ব না থাকলে এই জগৎ শুরুই হতে পারত না।
দার্শনিক ভাষায়: Infinite Regress ও First Cause
এই যুক্তিকে বলা হয় “First Cause Argument”। এখানে ধারণাটি হলো:
• যদি সব কিছুর একটি কারণ থাকে, তবে কোনো এক জায়গায় গিয়ে সেই কারণের শুরুটা খুঁজে পেতেই হবে।
• যদি কারণের কারণের কারণ এভাবে অনন্তকাল চলতে থাকে (Infinite Regress), তাহলে কোনো ঘটনাই ঘটবে না।অর্থাৎ, “there can’t be an infinite regress of causes”.
• সুতরাং, একটি চূড়ান্ত কারণ থাকা জরুরি, যে নিজে caused নন—তাঁকে বলা হয় First Cause বা Uncaused Cause।
এই যুক্তি যুক্তিবাদী, কারণ এটি জগতে ঘটে যাওয়া ঘটনা, পরিবর্তন ও অস্তিত্বের ভিত্তিতে নির্মিত।
ইসলামের সঙ্গে মিল: আল্লাহ – চূড়ান্ত সত্তা
এই যুক্তিগুলো শুধুমাত্র দার্শনিক চেতনার ফসল নয়। ইসলাম বহু আগেই আমাদের জানিয়ে দিয়েছে সেই চূড়ান্ত সত্তার কথা, যিনি কারো সৃষ্টি নন, বরং তিনিই সব কিছুর স্রষ্টা।
কুরআনে সূরা ইখলাসে বলা হয়েছে—
قُلْ هُوَ ٱللَّهُ أَحَدٌ
ٱللَّهُ ٱلصَّمَدُ
لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ
وَلَمْ يَكُن لَّهُۥ كُفُوًا أَحَدٌ
অনুবাদ:
বলুন, তিনিই আল্লাহ, একমাত্র।
আল্লাহ অমুখাপেক্ষী (সকল কিছু তাঁর ওপর নির্ভরশীল)।
তিনি জন্ম দেননি, এবং তাঁকেও কেউ জন্ম দেয়নি।
তাঁর সমতুল্য কেউ নেই।
এই আয়াতগুলোতে আমরা যে চিত্র পাই, তা হুবহু অ্যারিস্টটলের First Cause বা Unmoved Mover এর ধারণার সঙ্গে মিলে যায়।
• তিনি কারো সৃষ্টি নন
• তিনি সব কিছুর উৎস
• তিনি অন্য কিছুর উপর নির্ভরশীল নন, বরং সব কিছু তাঁর উপর নির্ভরশীল
বিজ্ঞান বনাম দর্শন বনাম বিশ্বাস: সংঘর্ষ নয়, সংলাপ
অনেকে মনে করেন, বিজ্ঞান ও বিশ্বাস যেন দুই বিপরীত মেরু। কিন্তু সত্যি বলতে—বিজ্ঞান খোঁজে কিভাবে (How), দর্শন খোঁজে কেন (Why), আর বিশ্বাস জানায় কে (Who)।
এই তিনটি প্রশ্ন একত্রে মিলেই আমাদের দৃষ্টিকে গভীর করে তোলে।
বিজ্ঞান বলে: মহাবিশ্বে সব কিছুর নিয়ম আছে।
দর্শন বলে: তাহলে এই নিয়ম কোথা থেকে এলো?
বিশ্বাস বলে: এই নিয়মের উৎস এক, তিনিই আল্লাহ।
উপসংহার: চিন্তা থেকেই ঈমানের পথ
সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করা মানেই ঈমান দুর্বল হয়ে যাওয়া নয়। বরং এটাই তো চিন্তার প্রথম ধাপ। দার্শনিকরা যুক্তির ভাষায় যাকে “First Cause” বলেন, মুসলমানরা তাকেই বলেন “আল্লাহ”।
তাই আসুন, আমরা শুধু বিশ্বাস করি না—ভাবি, প্রশ্ন করি, খুঁজি। কারণ চিন্তা থেকেই জন্ম নেয় দৃঢ় বিশ্বাস।
আপনার মতামত আমাদের জানাতে ভুলবেন না। আপনি কি মনে করেন এই যুক্তিগুলো সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বকে প্রমাণ করে? নিচে মন্তব্য করুন। আর ভালো লাগলে শেয়ার করুন—চিন্তার আলো ছড়িয়ে পড়ুক।
লেখক – মোঃ ফজলে রাব্বী
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়