Skip to main content

নাদিয়া মোরাদের যে গল্পটা বিশ্ব-বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছিল


ছবিতে : নাদিয়া মোরাদ 


নাদিয়া মোরাদের যে গল্পটা বিশ্ব-বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছিল 


নাম নাদিয়া মুরাদ বাসে তাহা । সংক্ষেপে নাদিয়া মুরাদ ।  ১৯৯৩ সালে ইরাকের উত্তরাঞ্চলীয় ছোট্ট গ্রাম কোজোতে যার  জন্ম ।  প্রথমদিকে তার জীবনটা আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো সুন্দর আর স্বাভাবিক ছিল । কিন্তু একটি দুর্ঘটনা তার জীবনকে পুরোপুরি বদলে দেয়  । নাদিয়ার জীবনে কি এমন ঘটেছিল যা তাকে একটা সাধারণ মেয়ে থেকে একজন যৌনদাসিতে পরিণত করেছিল ।  তার জীবনে আর কি কি পরিবর্তন এসেছিল যার ফলে তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার   'নোবেল পুরস্কার' লাভ করেন! 

প্রিয় পাঠক, আজ এ বিষয়েই কথা বলব । 

সময়টা ৩রা আগস্ট ২০১৪ । আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আই এস (ইসলামিক স্টেট) জাতীগত বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে ইরাকের সিন্জারে অবস্থিত কোজো গ্রামটিতে হামলা করে । এ পর্যন্ত তারা সেখানে ৭৩ বারেরও অধিক বার গণহত্যা চালায়  । শেষবার ২০১৪ সালে যখন হামলা করে তখন নাদিয়ার ছয় ভাই ও মা সে গণহত্যার শিকার হয় ।

সে গ্রামের অল্প বয়সী মেয়েদের তারা বন্দি করে নিয়ে যায়  । সেখানে ৬ হাজার ৭ শতাধিক মেয়ের মধ্যে নাদিয়াও ছিলেন । তারা নাদিয়াকে মাসুল শহরে যৌনদাসি হিসেবে বিক্রি করে দেয় । সেখানে তাকে নানাভাবে শারীরিক নির্যাতন করা হতো । সিগারেটের আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিত তার শরীরের বিভিন্ন অংশ । সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে সে অত্যাচারের মাত্রা আরো বহুগুণ বৃষ্টি পেয়ে যেত । যে কারণে নাদিয়া বহুবার গণধর্ষণের শিকার হন । 

তিন মাসের মতো সময় ধরে তারা নাদিয়াকে যৌনদাসি হিসেবে জিম্মি রেখেছিল । এক রাতে কারারক্ষী তার বন্দিশালার তালা খুলে রেখে চলে গেলে নাদিয়া সে সুযোগটা কাজে লাগিয়ে পালিয়ে যান ।

ধরা পড়লে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও সাহসের উপর ভর করে আর পেছনে ফিরে তাকান নি । অন্ধকার পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে  ক্লান্ত হয়ে এক বাড়িতে আশ্রয় নেন । সে পরিবারটিই তাকে আইএস অধ্যুষিত 'মাসুল' শহর থেকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে  । 

নাদিয়া ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি বেলজিয়ান দৈনিক পত্রিকা  'লা লিব্রে বেলজিক'কে প্রথম সাক্ষাত্কার দেন । একই বছর ১৬ই ডিসেম্বরে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মানবপাচার ও যুদ্ধ ইস্যুতে বক্তব্য রাখেন  । 

২০১৬ সালে  'এটর্নি আমাল ক্লুনি' নামে একজন আইনজীবী তার পাশে দাঁড়ান।

সে সময়  জাতিসংঘের 'মাদক ও অপরাধ' বিষয়ক বিভাগে বক্তব্য রেখে তিনি বলেন-  'আইএস কমান্ডারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে তিনি একজন মক্কেল হিসেবে নাদিয়াকে একজন প্রতিনিধি হিসেবে মনোনীত করেছেন  । 

এরপর থেকে নাদিয়ার দুঃসহ জীবনের মোড় ঘুরতে শুরু করে । আইএস কর্তৃক নির্যাতিত নাদিয়া হয়ে ওঠেন যৌন নির্যাতনের শিকার সকল নিরাপরাধ নারীদের সাহসিকতার প্রতীক  । 

"নাদিয়া'স ইনিশিয়েটিভস" নামে তিনি একটি  প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন, যেখানে গণহত্যা, ভয় নিপীড়ন এবং মানবপাচারের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত নারী ও শিশুদের জীবন ও সম্প্রদায়কে পুনঃস্থাপন, পুনর্নির্মাণ এবং আইনী সহায়তা করার জন্য নিবেদিত  ।

২০১৭ সালে নাদিয়া তার জীবনে ঘটে যাওয়া  কাহিনীগুলো নিয়ে 'দ্য লাস্ট গার্ল'' নামে  একটা বই প্রকাশ করেন । এই বইটিতে তিনি একটা প্রত্যাশা রেখে বলেন,

যৌন সহিংসতার শিকার নারীদের মধ্যে তিনিই যেন সর্বশেষ ভুক্তভোগী, তার পরে যেন আর কেউ এই নিপীড়নের শিকার না হয় ।

'যৌন নির্যাতনকে যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার বন্ধে অবদানের জন্য ২০১৮ তাকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।  তিনিই প্রথম ইরাকি হিসেবে এই সম্মানজনক পুরস্কারটি লাভ করেন । 

বর্তমানে তিনি একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন।  নাদিয়া মোরাদ বিশ্বাস করেন,  এই পৃথিবীটা একটা সুশোভিত ফুলের বাগান।  ধর্ম-বর্ণ-জাতী-গোত্র-সম্প্রদায় হলো এক একটি ফুল । যখন এই এক একটি ফুল নিজের সৌরভ মেলে ধরার সুযোগ পাবে, তখনই কেবল এই সুন্দর পৃথিবী সুন্দর থেকে সুন্দরতর হয়ে উঠবে ।


লেখা- মোঃ ফজলে রাব্বী